G A S O N L I N E

Since 2003

#Gasonline

Home Discover Institutions Contact Us
Apply online Admission 2025 Online Fees Payment
রবীন্দ্রমননে আত্মানুভূতির আলোকবর্তিকাঃ একটি ক্ষুদ্র দার্শনিক অনুসন্ধান

জীবনভাবনা যদি দার্শনিকতা হয়, তবে তার জন্ম কীভাবে? মানুষের জীবনে যা কিছু ঘটে, যা কিছুর অস্তিত্ব আছে, তারই প্রসূত হলো জীবনভাবনা। এ জীবন জিজ্ঞাসা আমাদের মনকে বারবার  অনুরণিত করে। দার্শনিক শংকরাচার্যের মতে এ মানুষের নয় পশুর প্রবৃত্তি। যা ত্যাগ করতে পারলে ব্রক্ষের উপলব্ধি হবে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের দার্শনিকতা জীবনকে অস্বীকার করে নয়। প্রবৃত্তি পশুদের ও মানবসমাজে উভয়েই প্রযোজ্য। কিন্তু মানুষ প্রেমে, ত্যাগে মহৎ হয়ে উঠতে পারে। রবীন্দ্রনাথের এই জীবনভাবনাই দার্শনিকতাকে নবরূপ দান করেছে।

তাই দার্শনিক -রবীন্দ্রনাথ কিন্তু জীবন থেকে সরে গিয়ে কোনো মহৎ দার্শনিক তত্ত্বের সৃষ্টি করেননি। জীবনের মাঝে দাঁড়িয়ে সবকিছুকে স্বীকার করে, জীবনকে কেন্দ্র করে যে জীবনভাবনা গড়ে তুলেছেন, তাকে দার্শনিকতা বলা গেলেও যেতে পারে এবং তা হয়তো একধরনের  জীবনদর্শন - এই হলো ড. রাধাকৃষ্ণনের মতামত। প্রথাগত দার্শনিকতার উর্দ্ধে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ এক নবদার্শনিকতার সৃষ্টি করেছেন তা বলাই বাহুল্য।

বস্তুত, রবীন্দ্রনাথের জীবনভাবনার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হল বিশ্ববিধানের বা জীবনের সত্যানুসন্ধান রবীন্দ্রনাথের এই সত্যানুসন্ধান বস্তুত প্রাচীন ঋষিদের ন্যায়, যারা শেষপর্যন্ত অন্তর বা মনকেই উপলব্ধির জগৎ বলে স্বীকার করেছেন। রবীন্দ্রমননে এই আকাঙ্খার প্রথম সূত্রপাত হয় বোধহয়, তাঁর উপনয়নের সময়। ১৮৭৩ সালে রবীন্দ্রনাথের উপনয়ন হয়। তখন তাঁর বয়স মাত্র এগারো বৎসর নয় মাস। ব্রাহ্মণমাত্রেই নতুন ব্রহ্মচারীকে উপনয়নের পর গায়ত্রীমন্ত্র জপ করতে হয়। এই গায়ত্রী মন্ত্র যখন প্রথম উচ্চারণ করেন তিনি, তখন বিশ্বপ্রকৃতিকে অনুভব করার তাগিদ তাঁর প্রথম অনুভূত হয়। তিনি বলেছেন------- "নুতন ব্রাহ্মণ হওয়ার পরে গায়ত্রী মন্ত্রটা জপ করার দিকে যুবার-একটা ঝোঁক পড়িল।" মন্ত্রজপের সময় তিনি গ্রহমণ্ডল সমেত আকাশের বিরাট রূপকে মনে আনতে চেষ্টা করতেন। বিশ্বানুভূতির চেষ্টা এই প্রথম। তাঁর বয়সের বালকের পক্ষে যতটুকু উপলব্ধি করা সম্ভব ততটুকুই তিনি করেছেন। গায়ত্রী মন্ত্রের তাৎপর্য উনি সে বয়সে যে সম্পূর্ণরূপে বুঝতেন, এমনটাও নয়। অর্থাৎ মানুষের অন্তরের মধ্যে এমন একটা কিছু আছে যা সম্পূর্ণ না বুঝলেও চলে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,------- "আমাদের পড়িবার ঘরে শানবাঁধানো মেজের এক কোণে বসিয়া গায়ত্রী জপ করিতে করিতে সহসা আমার দুই চোখ ভরিয়া কেবলই জল পড়িতে লাগিল। জল কেন পড়িতেছে তাহা আমি নিজে কিছুমাত্রই বুঝিতে পারিলাম না"।

আসলে আমাদের অন্তরে আকস্মাৎ এমন এক কাজ চলে বুদ্ধি সর্বদা তার ব্যাখ্যা দিতে পারে না। গায়ত্রী মন্ত্রের বিশেষ প্রভাব পড়ে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে। তিনি সবিনয়ে বলেছেন --
"...the text of our everyday meditation in the Gayatri, a verse which is considered to be the epitome of all the Vedas. By its help we try to realise the essential unity of the world with the conscious soul of man; we learn to perceive the unity held together by the one Eternal Spirit, whose power creates the earth; the sky, and the stars and at the same time irradiates our minds with the light of a consciousness that moves and exists in unbroken continuity with the outer world." এ চেতনা বিশ্বচেতনা।

রবীন্দ্র মননে এই উপলব্ধি তীব্রতর হয় রবীন্দ্রনাথের ঠিক উপনয়নের পরেই শান্তিনিকেতন ভ্রমণে। শান্তিনিকেতনে বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে তিনি প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ পেলেন। প্রকৃতিকে অনুভব করলেন। প্রকৃতির মধ্যে নিজেকে অনুভব করলেন।  যে উদ্বৃত্তের সৃজনীশক্তি মানুষের মধ্যে শুরুর থেকেই থাকে, তবুও মানুষ অকস্মাৎ এর উৎক্ষেপন অনুভব করতে পারে এবং রবীন্দ্রজীবনেও বিষয়টি ভিন্ন নয়। এই আলোচ্য বিষয়টিও রবীন্দ্রনাথের নিজ অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে। তাঁর এই অভিজ্ঞতা তাঁর কবিতা নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ, কবিতায় প্রকাশিত। 

কবির অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বহির্জগতের এক দিব্যরূপ দেখলেন। তখন তাঁর চোখের উপর থেকে অন্ধকারের পর্দাটাই শুধু সরে গেল না, 'সন্ধ্যাসংগীত' রচনাকালে কবি হৃদয়-অরণ্যের যে পথ হারিয়েছিলেন সেই হারানো পথের সন্ধান পেলেন। এতকাল কবি যে বিষাদাচ্ছন্ন হৃদয়ে দুঃখের গান গাইছিলেন এবারে তার অবসান হলো। সন্ধ্যার পর গভীর রাত পেরিয়ে যেন প্রভাতের আবির্ভাব। সেদিনের সেই প্রভাতবেলা কবির জীবনে যে নতুন বার্তা নিয়ে এসেছিল তা সারাজীবন কবিতে তাড়িত করেছে। প্রতিদিন নিয়ম মতো সূর্যোদয় ঘটেছে, কিন্তু ঐদিনের সূর্যোদয়ে আলোকরাশি এতদিন যেখানে প্রবেশ করেনি অথবা করতে পারেনি, আজ সেই প্রাণের গভীরে প্রবেশ করেছে:

"আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের পর,
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান।
না জানি কেনরে এতদিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ।"

তিনি তাঁর আত্মজীবনী, জীবনস্মৃতি এবং অনান্য বিভিন্ন রচনাতে এই কবিতার প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক বিবরণ দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ কলকাতার পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে যখন বসবাস করেন, তখন ভোরবেলায় তিনি এক অভূতপূর্ব অনুভূতি লাভ করতেন। ঝুলবারান্দা বেঁকে সূর্যকে গাছগুলির পিছন থেকে উঠতে দেখেন। এই দৃশ্য দেখে তিনি অনুভব করেন তাঁর চোখের সামনে থেকে যেন একটি পর্দা সরিয়ে নেওয়া হল এবং তখন তিনি সকল বস্তুকে তরঙ্গের মধ্যে নৃত্যশীল কল্পনা করেছেন। অনুভূত হয় রবীন্দ্রমননে সৌন্দর্য। এই দৃষ্টি কেবলমাত্র ইন্দ্রিয়দৃষ্টি নয় তা কল্পনাদৃষ্টি এবং তা সম্পূর্ণরূপে চেতনার দ্বারা অনুভূত। এরূপচেতনা দ্বারাই বিশ্বপ্রকৃতিকে অনুভব করা যায়। নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ রবীন্দ্রনাথের আত্মজাগৃতি ও চৈতন্য বিস্তারের আরম্ভকাল। তাঁর এই আত্মানুসন্ধান, আত্মানুভূতির, আত্মচেতনার আকুলতা আজীবন অটুট ছিল। তাই জীবনের শেষপ্রান্তে পৌঁছেও তার আত্মমনন ধ্বনিত হয় "আমি" তে:

“আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ,
                          চুনি উঠল রাঙা হয়ে।
                      আমি চোখ মেললুম আকাশে,
                          জ্বলে উঠল আলো
                               পুবে পশ্চিমে।
                   গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম ‘সুন্দর',
                               সুন্দর হল সে।
                      তুমি বলবে, এ যে তত্ত্বকথা,
                                  এ কবির বাণী নয়।
                          আমি বলব, এ সত্য,
                                  তাই এ কাব্য।
                           এ আমার অহংকার,
                             অহংকার সমস্ত মানুষের হয়ে।
                        মানুষের অহংকার - পটেই
                              বিশ্বকর্মার বিশ্বশিল্প। “


**রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক অনুভবের নাম। তাঁর জীবন দর্শন, আত্মচেতনা এক মহাসমুদ্র। আমার এই লেখা, এই স্বল্প পরিসরে তারই একটি ক্ষুদ্র অংশ তুলে ধরার প্রয়াস মাত্র।

তথ্যসুত্রঃ
---------------------------------
১.ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, জীবনস্মৃতি, বিশ্বভারতী,১৪২১.
২.ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, মানুষের ধর্ম, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা, ১৪১৮.
৩.মল্লিক, শঙ্কর, কবির আত্ম আবিষ্কারের আনন্দ একটি রচনা।
৪.রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্র রচনাবলী। 
৫. সঞ্চয়িতা।
৬.প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্র-জীবনী।
৭.আন্তর্জাল।

Satyajit Payra

Assistant Professor, Excellent Model College for Teacher Education

Related Post

blog
Vidyasagar A Beacon of the Yesterday a Guiding light for ...

সময়ের সঙ্গে সমাজ বদলায়, প্রযুক্তি এগোয়, চিন্তাধারার রূপান্তর ঘটে। তবুও কিছু মানুষ, কিছু মূল্যবোধ চিরকাল সময়ের “সীমার মাঝেও অসীম”…...... কালের গন্ডি তাঁদের বাঁধতে পারে না । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সেই বিরল মানুষদের একজন যাঁকে আমরা ইতিহাসের পাতায় রেখে এলেও, সমাজ এখনো তাঁর আদর্শের সন্ধানে পথ খোঁজে। আজ, তাঁর প্রয়াণ দিবসে, শুধু তাঁকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করলেই চলবে না, উপলব্ধি করতে হবে তাঁর প্রয়োজনীয়তা, যাঁর চিন্তা, যাঁর কাজ , শত বছর পরেও সমান প্রাসঙ্গিক I

blog
PAHAR PUJO A UNIQUE EXPRESSION OF NATURE WORSHIP AND INDIGENIOUS ...

জঙ্গলমহল - বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল - প্রাচীনকাল থেকেই এক অনন্য সংস্কৃতি, লোকবিশ্বাস ও প্রকৃতি -পূজার পীঠস্থান। এখানকার অজস্র পাহাড়, জঙ্গল, নদী আর লাল মাটির বুক জুড়ে গড়ে উঠেছে হাজারো বছরের আদিবাসী আচার-অনুষ্ঠান। তারই একটি গভীর অথচ আজ প্রায় বিস্মৃত প্রথা হলো পাহাড় পূজাপাহাড় পূজা এক আচার, যা কোনও ধর্মগ্রন্থে লেখা নেই, তবু শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এখানকার মানুষ মন প্রাণ ঢেলে পালন করে আসছে।

Leave a Comment