G A S O N L I N E

Since 2003

#Gasonline

Home Discover Institutions Contact Us
Apply online Admission 2025 Online Fees Payment
পাহাড় পুজো: প্রাকৃতিক শ্রদ্ধা ও আদিবাসী সংস্কৃতির এক অপরূপ নিদর্শন

জঙ্গলমহল - বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল - প্রাচীনকাল থেকেই এক অনন্য সংস্কৃতি, লোকবিশ্বাস ও প্রকৃতি -পূজার পীঠস্থান। এখানকার অজস্র পাহাড়, জঙ্গল, নদী আর লাল মাটির বুক জুড়ে গড়ে উঠেছে হাজারো বছরের আদিবাসী আচার-অনুষ্ঠান। তারই একটি গভীর অথচ আজ প্রায় বিস্মৃত প্রথা হলো "পাহাড় পূজা"। “পাহাড় পূজা’ এক আচার, যা কোনও ধর্মগ্রন্থে লেখা নেই, তবু শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এখানকার মানুষ মন প্রাণ ঢেলে পালন করে আসছে।

পাহাড় মানে দেবতা :

জঙ্গলমহলের মানুষ, বিশেষত সাঁওতাল, মুণ্ডা, ভীল, হো, ওরাওঁ প্রভৃতি আদিবাসী সম্প্রদায়ের কাছে পাহাড় শুধু ভূ-অবয়ব নয়; সে এক জীবন্ত, সজীব শক্তি। সে মায়ের মতো, রক্ষকের মতো, কখনও পিতৃস্বরূপ দেবতা। এখানে কোনও জাঁকজমক নেই, তবু পাহাড়-চূড়ায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা এক বিশাল পাথরকে তাঁরা বলে —

"ᱤᱧ ᱜᱮ ᱟᱵᱚ ᱴᱷᱟᱠᱩᱨ" “এটাই তো আমাদের ঠাকুর।”

তাদের বিশ্বাস, প্রত্যেক পাহাড়ে বাস করেন এক বা একাধিক "পাহাড় দেবতা (বুরুবঙ্গা)“, যাঁরা গ্রামের কল্যাণ রক্ষা করেন, জলবৃষ্টি দেন, ফসল ফলান, আবার রুষ্ট হলে খরা, রোগ, মহামারিও ডেকে আনেন। এই বিশ্বাস কোনও পুঁথি পড়ে শেখা নয় - এটা জীবনের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা থেকে গড়ে ওঠা শ্রদ্ধা। এই পাহাড় দিয়েছে কাঠ, ফল, পশুর আশ্রয়, আর জল - জীবন।

পূজার সময় ও পরিক্রমা :

এই পুজোয় কোনও বড় প্রতিমা বা জমকালো আয়োজন থাকে না, বরং প্রকৃতির কোলেই গড়ে ওঠে এক অনাড়ম্বর অথচ গভীর আধ্যাত্মিক পরিবেশ। আষাঢ়ের বা শ্রাবণের এক নির্দিষ্ট দিনে সকাল সকাল গ্রামের পুরুষেরা দল বেঁধে বেরোয়। কারও হাতে ঢোল, কারও কাছে তোলা মুরগি বা দেশি মদ। তারা নগ্ন পায়ে, দল বেঁধে ঢাক, কাঁসর ও ঢোল বাজিয়ে উঠে যায় পাহাড় চূড়ায়। গ্রামের বয়স্ক নায়কে সবার সামনে। পায়ে পায়ে তারা পৌঁছে যায় সেই নির্দিষ্ট পাহাড়ে, যাকে তারা ‘থানে পাহাড় বলে ডাকে। সেখানে এক পুরোহিত বা পুজারী, যাঁকে স্থানীয় ভাষায় 'নায়কে' বা 'পারহা' বলা হয় , পূজা পরিচালনা করেন।

চলতে চলতে ছেলেরা গায়: "ᱜᱟᱶᱨᱮ ᱵᱩᱨᱩ, ᱫᱷᱟᱱ ᱮᱢᱢᱮ, ᱡᱚᱞ ᱮᱢᱢᱮ, ᱨᱚᱜᱵᱚᱜ ᱫᱩᱨ ᱢᱮ" গাঁওরে পাহাড় ঠাকুর, ধান দিও, জল দিও, রোগভোগ দূর করো…”

এই গান কাঁপিয়ে তোলে অরণ্যকে। পৌঁছেই পাহাড়ের পাদদেশে পাতা হয় মাটি-ঠাকুর। হলুদ, চাল, সিঁদুর, হাঁস-মুরগি আর দেশি মদ দিয়ে হয় পূজা। “জয় পাহাড় ঠাকুর” ধ্বনি ওঠে যখন বলি দেওয়া হয়। সে মুহূর্তে কারও চোখে জল, কেউ আবার নাচে উন্মাদ আনন্দে।

 পাহাড় পূজা শুধু ধর্ম নয় — সম্পর্কের স্বীকৃতি:

পাহাড় পূজা শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় আচারের নাম নয় — এটি মানুষ ও প্রকৃতির অন্তরঙ্গ সহাবস্থানের এক নিদর্শন। এই পূজা আসলে এক ধন্যবাদ জ্ঞাপন, প্রকৃতিকে বোঝার এক সহজ অথচ গভীর উপায়। এই পূজার মধ্য দিয়ে আদিবাসী সমাজ জীবনধারণের উৎসস্থলকে সম্মান জানায়, যাকে আমরা আধুনিক মননে ভুলে গেছি।

 আধুনিক সময়ে সংকটের ছায়া

তবে এও সত্যি যে জঙ্গল এখন আর আগের মতো নেই। পাথরকাটা, মাইনিং, রাস্তাঘাট তৈরি - সব কিছুর ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে পাহাড়, আর তার সঙ্গে হারাচ্ছে পাহাড় পূজা। যেখানে এক সময় ঢোল বাজত, এখন সেখানে চলে বুলডোজার। তবু কিছু সম্প্রদায় আজও একভাবে পালন করে যায় এই রীতি -শুধুই বিশ্বাস থেকে, কোনও স্বীকৃতির আশায় নয়।

 শেষ কথা: যা শিকড়ে ফেরায়

যুগ বদলেছে, জীবন বদলেছে।  আজকের দিনে, যখন জলবায়ু পরিবর্তনের মুখে বিশ্ব কাঁপছে, তখন জঙ্গলমহলের এই ছোট্ট গ্রামগুলো যেন চুপ করে বলে ওঠে:

পাহাড়ের কাছে মাথা নত করলে সে রক্ষা করে, নত না করলে সে মুছে দেয়।”

পাহাড় এখানে প্রকৃতির পরিপূরক এই পুজো আমাদের মনে করিয়ে দেয় , প্রকৃতির সঙ্গে যোগাযোগ হারালে, আমরা আমাদের শিকড় হারিয়ে ফেলি। মনে করায় শহরের কংক্রিটে নয়, এই লাল মাটির গন্ধেই আছে ভবিষ্যতের পথ। এই রকম লোকাচারকে বাঁচিয়ে রাখাটা শুধু একটি সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখা নয়, গোটা মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার  সংকট ও সংগ্রামও বটে।

 

Sanchita Roychowdhury

Related Post

blog
Midnapore Where Freedom Forged its Fire ...

When India’s independence story is told, Delhi’s political negotiations and Calcutta’s big rallies dominate the script. Yet far from the spotlight, Midnapore, now Purba and Paschim was a place where freedom was not a slogan but a lived dangerous commitment. Here, in dusty village lanes and small-town hideouts, people fought in ways that history books found too raw to celebrate.

Midnapore’s struggle was uncompromising. British reports called it “one of the most violent districts” due to political assassinations, sabotage, and underground networks. Colonial accounts painted the rebels as “terrorists,” while post-independence narratives leaned heavily on the Gandhian path, leaving these fighters unmentioned or misrepresented.

blog
Vidyasagar A Beacon of the Yesterday a Guiding light for ...

সময়ের সঙ্গে সমাজ বদলায়, প্রযুক্তি এগোয়, চিন্তাধারার রূপান্তর ঘটে। তবুও কিছু মানুষ, কিছু মূল্যবোধ চিরকাল সময়ের “সীমার মাঝেও অসীম”…...... কালের গন্ডি তাঁদের বাঁধতে পারে না । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সেই বিরল মানুষদের একজন যাঁকে আমরা ইতিহাসের পাতায় রেখে এলেও, সমাজ এখনো তাঁর আদর্শের সন্ধানে পথ খোঁজে। আজ, তাঁর প্রয়াণ দিবসে, শুধু তাঁকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করলেই চলবে না, উপলব্ধি করতে হবে তাঁর প্রয়োজনীয়তা, যাঁর চিন্তা, যাঁর কাজ , শত বছর পরেও সমান প্রাসঙ্গিক I

Leave a Comment